উপকূল

ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া,  ক্রেতাদের কপালে ভাঁজ ! 

কামরুল হাসান
২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৪৬ দুপুর
রূপালী ইলিশ। ছবি: সংগ্রহীত

দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে পরে বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হবে; এমন খবরে স্বস্তি মেলে কম আয়ের মানুষের। তারা ভেবেছিলেন-সাধ্যের মধ্যে আসবে দাম, পাতে উঠবে সুস্বাদু এই মাছ। কিন্তু সেই আশা নিয়ে বাজারে গিয়ে দেখা যায় উল্টো চিত্র। একদিকে সরবরাহ কম, অন্যদিকে দামও নাগালের বাইরে। ফলে দাম শুনেই কপালে ভাঁজ পড়ছে অনেকের।  


মৎস্য সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত পটুয়াখালীর নদী ও সাগর তীরবর্তী রাঙ্গাবালী উপজেলার কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। উপজেলার সদরের প্রাণকেন্দ্র বাহেরচর বাজারে ইলিশ নিয়ে এসেছেন তিনজন বিক্রেতা। হাতে গোনা তাদের কাছে এক কেজি বা তার চেয়ে কম ওজনের ৫-৬টি ইলিশ দেখা গেছে। বাকি সব জাটকা। চাহিদার তুলনায় তাও কম। তাই দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। জাটকা (২০০ গ্রাম) বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে। এক কেজির কাছাকাছি ওজনের ইলিশের দাম ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত হাকছেন বিক্রেতা। 


ইলিশ কিনতে বাজারে এসে চড়া দাম দেখে অনেকেই অন্য মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাদেরই একজন সিদ্দিক হোসেন। পেশায় তিনি কৃষক। সিদ্দিক বলেন, ‘ইলিশ মাছ কিনতে আসছিলাম। যে দাম, কেনার অবস্থা নাই। তাই অন্য মাছ দেখছি।’

মিরাজ নামের আরেকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘গত বছর এইসময় জাটকার কেজি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বড় ইলিশ কেজি ছিল হাজারের মধ্যে। আর এখন যে দাম, এতে গরীবের পাতে ইলিশ উঠবে না।’

বুড়াগৌরাঙ্গ নদ ও বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস বাজারে এদিন কোন ইলিশ ওঠেনি। মাছ কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন ফরিদ উদ্দিন নামের একজন ক্রেতা। তিনি বলেন, ‘সাগরপাড়ের এলাকায় থেকেও ইলিশ খাইতে পারি না। বাজারে পাঙ্গাশ, চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ ওঠে। কিন্তু ইলিশ পাই না। ঘাটে গিয়ে দুই-একজনে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেনে। তাও দাম বেশি।’ 


অথচ ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। তবুও নদ-নদীতে জেলেদের জালে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে সমুদ্রে যাওয়া জেলেদের জালে গত কয়েকদিন ধরে মোটামুটি ভালই ইলিশ ধরা পড়ছে। কিন্তু বড় ইলিশ তুলনামূলক কম হলেও ছোট ইলিশ এবং জাটকা পরিমাণে বেশি। জালে উঠছে অন্যান্য মাছও। তবুও স্থানীয় হাট-বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম।

বাজারে ইলিশ কম পাওয়ার কারণ?

এর কারণ খুঁজতে গেলে জানা যায়-সমুদ্রগামী বেশিরভাগ জেলে-ট্রলার মালিকরা পার্শ্ববর্তী কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর-আলিপুর মৎস্য বন্দরের মহাজনদের কাছ থেকে দাদন এনে ব্যবসা করেন। একারণে মহাজনদের মালিকানাধীন কিংবা তাদের নির্ধারিত মৎস্য আড়তেই মাছ বিক্রি করতে হয় তাদের। তাই সাগর থেকে মাছ ধরে সরাসরি মৎস্য বন্দরে নিয়ে যান জেলেরা। একারণে স্থানীয় বাজারগুলোতে সাগরের ইলিশ সরবরাহ নেই বললেই চলে। 


খুচরা বাজার ঘুরে জানা যায়, নদ-নদীতে ক্ষুদ্র জেলেদের ধরা ইলিশ পাইকারদের মাধ্যমে হাত বদলে বাজারে ওঠে। বাজারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় দাম নাগালের বাইরে; বলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। উপজেলার বাহেরচর বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মিরন আকন বলেন, ‘আমরা যে দামে কিনি (ক্রয়), সীমিত লাভেই বিক্রি করি। কেজি প্রতি ২০-৫০ টাকা লাভ হয়। জেলেরা মাছ বেশি পেলে দাম কমবে যাবে। তখন আমরাও কম দামে কিনে কম দামে বেচতে পারবো।’

ইলিশের দাম না কমার জন্য জেলেদের ভাষ্য কি?

জেলে পর্যায় থেকে ইলিশের দাম কেন কমছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে জেলেদের বরাত দিয়ে উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জহির হাওলাদার বলেন, ‘ইঞ্জিন চালিত ট্রলার দিয়ে জেলেরা মাছ ধরেন। সেক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের দাম বেশি। নিত্যপণ্যের বাজার চড়া। মাহজনের দাদন, ঋণের কিস্তি এবং পরিবারের খরচ মেটাতে হয় জেলেদের। সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণে এলে জেলেরাও কম দামে মাছ বেচতে পারবে। আর অন্য কিছুর দাম নিয়ন্ত্রণে না এনে মাছের দাম কমালে জেলেরাতো না খেয়ে মরতে হবে।’  

বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে কি বলছেন? 

এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের  সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এখন ইলিশের মৌসুম। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ইলিশ যে ধরা পড়ছে, বিষয়টা এমন নয়। নদ-নদীতে ইলিশ খুবই কম ধরা পড়ছে। এর পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগরেও ঠিকমত মাছ ধরতে পারছেন না জেলেরা। তাই বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। একারণে দাম বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করছিÑবৈরী আবহাওয়া শেষে জেলেদের জালে আশানুরূপ  মাছ ধরা পড়বে। জেলেরা লাভবান হবেন। তখন দামও কমবে। কিন্তু নিত্যপন্য এবং জ¦ালানি তেলের দাম না কমিয়ে মাছের দাম কমালে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’