আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। উপকুলবাসীর বিভীষিকাময় এক দুঃস্বপ্নের দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ক্ষতবিক্ষত করে দেয় বিভিন্ন এলাকার জনপদ। উপকূলীয় জনপদগুলো মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে দেয়। ওই ঝড়ে পটুয়াখালীর বিছিন্ন দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীতে হারিয়ে যায় হাজার হাজার প্রাণ। নিখোঁজ হয় সহস্রাধিক মানুষ। এক এক করে ৫৪ বছর পেরিয়ে গেল। আজও কান্না থামেনি স্বজনহারা মানুষের। রয়ে গেছে সেই ক্ষত। ১৯৭০ সালের ঝড়ে পটুয়াখালীর বিছিন্ন দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীতে হারিয়ে যায় হাজার হাজার প্রাণ। ভোলা সাইক্লোনে লন্ডভন্ড করে দেয় রাঙ্গাবালীকে।
স্বজনহারা মানুষরা জানান, এখনো সেই কথা মনে করলে আঁতকে উঠেন উপকূলবাসী। সেদিন ১০ থেকে ১২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের পানি সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাস্তায়, গাছে, ফসলের মাঠে হাজার হাজার মানুষ,গরু, ছাগল, পশুপাখির মরদেহ পড়ে ছিল। এক গর্তে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয় একাধিক লাশ। এমনকি অনেকের লাশও খুঁজে পাননি স্বজনরা। কারো কারো পরিবারে কেউ বাঁচতে পারে নাই সেদিন। ঘূর্ণিঝড়ের পরেও পানি ও খাবারের অভাবেও মারা যান অসংখ্য মানুষ। সেই সৃতি যেনো ভুলতে পারেনা এই উপকূলবাসী।
১৯৭০ সালের ঝড়ে বাবা-মাকে হারিয়েছেন মনোয়ারা বেগম কথা হয় তার সাথে তিনি বলেন,‘সেদিনের কথা মনে পরলে এখনো পরানটার মধ্যে কেমন জানি করেন। সেই বইন্যায় (বন্যা) আমার মা-বাবাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পানিতে তাদের আর খুঁজে পাই নাই। ঝড়ের পর দেখি লাশ আর লাশ সেই ঝড়ে যে কত মানুষ মারা গেছে রাঙ্গাবালীর তার কোনো হিসাব নাই। ঝড়ের পরও খাবার ও পানির অভাবে মারা গেছে অনেক মানুষ।’ সুদু মনোয়ারা বেগম নয় এমনও স্বজনহারা পরিবার আছে এ উপজেলায় হাজার হাজার।
কথা হয় চর ইমারশনের বাসিন্দা রুহুল ফকিরের সাথে তিনি জানান, ‘ঝড়ের সময় তিনি গাছ ধরে বেঁচে ছিলেন। সেদি তার পরিবার থেকেও মারা যান অনেক মানুষ। সেদিন ওই ঝড়ে কত মানুষ যে মারা যায় তার কোনো হিসাব নাই , তা আমরা বলতে পারি না। আমাদের অনেক কষ্ট হইছে কারণ পানি পান করতে পারি নাই, ভাত খেতে পারি নাই। আমরা সেদিন কোম্ভা (পেঁপে) গাছের ঘোরা রান্না করে খেয়ে বেঁচে ছিলাম। আজও সেই কথা মনে পরলে কষ্ট বুকটা ফেটে যায়। যদি ঝড়ের কথা শুনি তাহলে এখনও বুকটা কেঁপে উঠে।’
এই উপজেলার স্বজনহারা মানুষ কেউ মাকে, কেউ বাবা, আবার কেউ ভাই, কেউ বোনকে হারিয়েছে। স্বজনহারা মানুষের তথ্য মতে, ১৯৭০ সালে কোন রেডিও ছিলো না, তারা কোন খবর পায় নাই, এবং যারা পেয়েছে তারা অনেকেই আবার বিশ্বাস করে নাই। আবার ওইদিন সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় হালকা বাতাস। গভীর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছিল তখনই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। ঝড় আর পাহাড়সম স্রোতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূল। কিন্তু এত বছর পরও ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় রাঙ্গাবালীতর প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ আজো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ভোলা জেলায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসেছিল ভোলা সাইক্লোন। সেদিন লক্ষ্মীপুরের মেঘনা ও ভুলুয়া নদী উপকূলে ঘূর্ণিঝড়টি ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হেনেছে। প্রায় ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে হাজার হাজার মানুষ ও গবাধি পশু। সেদিনের জলোচ্ছ্বাসে মেঘনা উপকূলীয় এ অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাইক্লোনটিতে ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে ওইদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছে।
অনেকেই মা-বাবা ভাই-বোন সন্তান হারিয়েছে ওই ঘূর্ণিঝড়ে। এখনো ঝড়ের কথা শুনলে আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসি। ওই ঝড়ে কেউ গাছে আবার কেউ ঘরের চাল ধরে জীবন বাঁচিয়েছেন। এমকি কোনো কোনো পরিবারের বেঁচে ছিলোনা সেদিন। ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোন ঝড়ের সৃতি ভুলতে পারিনি এখনও তারা।
বেসরকারি সংস্থা জাগোনারী প্রকল্প সমন্বয়কারী শাহিন আহম্মেদ বলেন,‘ ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায় এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে যদি বলি পৃথিবীর ইতিহাসেও এটা বিরাল ঘটনা । উপকূলবাসী ১২ই নভেম্বর কে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলো এ দাবি জানিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়াতে বন্যা বাঁধ গুলো (বেড়ী বাঁধ) উপছিয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পরছে। বেরিবাধ উঁচুকরণ এ অঞ্চলের খুবই প্রয়োজন না হলে সাগরের লোনা পানি লোকালয়ে ঢুকে মিঠা পানির উৎস গুলোকে নষ্ট করে দিবে ।