ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, শিশুদের অধিকার রক্ষা, সাংবাদিকতা এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কিশোর মুনতাসির তাসরিপ। শিশু বয়সেই তিনি অসংখ্য সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন আন্দোলনে, প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সাংবাদিকতায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেয়া এ অদম্য কিশোর। তার কাজ শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
শৈশবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শুরু-
২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে জন্মগ্রহণ করেন মুনতাসির তাসরিপ। তার বাবা মোহাম্মদ আলী একজন আইনজীবী এবং মা বিলকিস বেগম একজন গৃহিণী। উপজেলার কালাইয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছেন মুনতাসির। শৈশব থেকেই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি লক্ষ্য করেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অ্যাসাইনমেন্ট ফি ও দ্বিগুণ বেতন আদায় করা হচ্ছে। তিনি এর প্রতিবাদ করেন এবং অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও বিষয়টি ভাগ করে নেন। এরপর থেকেই তার মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে।
আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্বের সূচনা-
২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর এসএসসি পরীক্ষার সিলেবাস কমানোর দাবিতে মুনতাসিরের নেতৃত্বে বাউফল প্রেসক্লাব চত্বরে এক বিশাল মিছিল, মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ অনুষ্ঠিত হয়। তার সাহসী নেতৃত্ব জাতীয় দৈনিকগুলোতে জায়গা করে নেয়। এরপর থেকে একের পর এক আন্দোলন ও প্রতিবাদে তিনি যুক্ত হন।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই পটুয়াখালী জেলায় প্রথমবারের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি। এদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ। বাউফল থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত পটুয়াখালীর অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন চলে ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
গণহত্যার পর পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বহুদিন ধরে পালিয়ে থাকতে হয়েছে মুনতাসিরকে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারা হুমকি ও লাঞ্ছিত হয়েছেন বহুবার। তবুও দমে যাননি তিনি। শুধু সরকার পতন পর্যন্ত নয়, সরকার পতনের পর পুনরায় দেশ গঠনে রয়েছে তার অসাধারণ ভূমিকা। ৫ আগস্টের পর একের পর এক কার্যক্রম তার বাস্তব উদাহরণ।
এসবের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, দখলদারি, অগ্নিসংযোগ, রাহাজানি রোধে শান্তি সমাবেশ, বাজার মনিটরিং, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, থানায় গণঅভিযোগ, নানা সময়ে নানা বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, প্রতিবাদ, গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল ইত্যাদি।
সাংবাদিকতার প্রতি ভালোবাসা ও পথচলা-
সাংবাদিকতার প্রতি মুনতাসিরের আগ্রহ জন্ম নেয় যখন তিনি সমবয়সী এক বন্ধুকে সংবাদ সংগ্রহ করতে দেখেন। তিনি ভাবেন, "সে যদি পারে, তাহলে আমিও পারব!"
১৪ বছর বয়সেই স্থানীয় একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। যদিও শুরুর দিকে তিনি নানা বাধার সম্মুখীন হন—বন্ধুদের হাসাহাসি, বড়দের তাচ্ছিল্য, শিশু সাংবাদিক হিসেবে অবজ্ঞা—কিন্তু তিনি দমে যাননি।
২০২২ সালের শুরুতে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’-এ শিশু সাংবাদিকতার জন্য আবেদন করেন এবং সুযোগ পান।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনি হ্যালোর একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে শিশু সাংবাদিকতার সনদ অর্জন করেন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি শুরু করেন এবং একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকেন।
বেদে শিশু, মান্তা শিশু, কারখানার শিশুশ্রমিক, টোকাই শিশু, অবহেলিত চরের রুগ্ন দেহের ঝরে পড়া শিশুদের গল্প নানা সময়ে তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের ঘটনাগুলো তার প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে শিশুদের ক্ষতির বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন নানা প্রতিবেদনে। তুলে ধরেছেন সম্ভাবনাময় শিশুদের খবরও।
স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম ও নেতৃত্ব-
শুধু সাংবাদিকতা নয়, মানবসেবার জন্যও কাজ করতে শুরু করেন মুনতাসির। ১৪ বছর বয়সেই তিনি ‘মানবতার বন্ধু’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি হন। এরপর নিজেই ২০২৩ সালের জুনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘তারুণ্যের জাগরণ’ নামক একটি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি—অসহায় নারীদের সহায়তা, শিশুদের পোশাক বিতরণ, স্কুলে ডেঙ্গু সচেতনতা কার্যক্রম, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, দরিদ্র পরিবারের মাঝে ঈদের বাজার পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তার এসব কাজ এলাকার মানুষদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান রূপান্তরের "আস্থা" প্রকল্পের আওতায় মুনতাসিরের নেতৃত্বে ‘বাউফল যুব ফোরাম’ নামে একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মুনতাসিরের নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় এবং রূপান্তরের আয়োজিত ‘যুব উৎসব ২০২৫’-এর উদযাপন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করে সারা পটুয়াখালীতে সাড়া ফেলেন মুনতাসির তাসরিপ।
দুর্যোগকালীন সময়ে উপকূলীয় এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন তিনি। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঝুঁকিতে থাকা নদী উপকূলীয় মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বাউফল ইউনিটের উপ-যুবপ্রধান হিসেবেও কাজ করছেন।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা-
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সুখ্যাতি রয়েছে মুনতাসির তাসরিপের৷ বাউফল শিল্পকলা একাডেমির সদস্য হিসেবে উপজেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত ৷ গান, আবৃত্তি ও বক্তৃতার মত বিষয়গুলোতেও বেশ পটু এই কিশোর।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-
২০২৪ সালের ২ এপ্রিল জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) আয়োজিত ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’-এ ভিডিও, টেক্সট ও ফটোগ্রাফি—এই তিনটি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হন মুনতাসির। এটি ছিল পটুয়াখালীতে প্রথমবারের মতো কোনো শিশু সাংবাদিকের এই অর্জন।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে মুনতাসিরের প্রতিবেদন-
জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে ইউনিসেফ আয়োজিত প্রি-বাজেট সম্মেলনে, শিশু অধিকার নিয়ে তৈরি করা মুনতাসিরের দুটি ভিডিও প্রতিবেদন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে দেখানো হয়। সে সময় তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপসহ ১৮ জন সংসদ সদস্য তার প্রতিবেদন দেখে প্রশংসা করেন।
অদম্য পথচলায় অনুপ্রেরণার প্রতীক-
শিশু বয়সেই সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা, শিশু অধিকার রক্ষা, সাংবাদিকতা এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া সত্যিই বিরল। মুনতাসিরের স্বপ্ন—শিশু অধিকার রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা এবং নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা।
তার স্বপ্ন, সাহস ও নেতৃত্ব আগামীর বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।