মতামত
এম সোহেলের গল্প

"চিঠি কেবল তোমার নামে"

এম সোহেল
০১ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৯ রাত

নীলার বয়স তখন মাত্র ২২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে ইংরেজি সাহিত্যে। বই, কফি আর বৃষ্টির প্রতি তার ছিল অদ্ভুত এক দুর্বলতা। সে ভালোবাসত চুপচাপ জানালার ধারে বসে থাকত, ভিজে শহরের ভেতর মানুষ দেখতে।

আর রুদ্র? গ্রামের ছেলে। অর্থনীতি পড়তে এসেছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চারণে হালকা আঞ্চলিক টান, চোখে অপার স্বপ্ন, আর গলায় ছিল অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। সে কথা কম বলত, কিন্তু বললেই মন ছুঁয়ে যেত।

তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। নীলা তখন ব্রাউনের "The Wasteland" পড়ছিল, রুদ্র এসে চুপচাপ পাশে বসে বলেছিল,
"তুমি কী জানো, ভালোবাসার শোক সবচেয়ে নীরব হয়?"

নীলা তাকিয়ে ছিল, খানিক অবাক হয়ে। "তুমি কে?"
রুদ্র হেসেছিল। "একজন, যে হয়তো তোমার গল্পে আসতে চায়।"

সেই শুরু। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক আশ্চর্য বন্ধুত্ব। তারা একসাথে পড়ত, হাঁটত, কফি খেত, বৃষ্টিতে ভিজত। রুদ্র মাঝে মাঝে নীলাকে চিঠি লিখত—আধুনিক যুগে যখন সবাই হোয়াটসঅ্যাপ করে, তখন সে লিখত হাতে, নীল কালিতে।

চিঠিগুলো ছিল অদ্ভুতভাবে গভীর—
"নীলা, জানো? আজ যখন তোমার চোখে পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল, আমি সত্যিই আছি। যেমন ধরা পড়ে ছায়া আলোয়।"

নীলা কখনো জবাব দিত না, শুধু পরের চিঠির অপেক্ষায় থাকত।

একদিন বিকেলে, ক্যাম্পাসের পেছনের বটগাছটার নিচে তারা বসেছিল। রুদ্র হঠাৎ বলল,
"নীলা, যদি একদিন আমি চলে যাই, তুমি কী করবে?"

নীলা হেসে বলল, "তুমি কোথায় যাবে?"

রুদ্র উত্তর দেয়নি। শুধু তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে।

সেই রাতেই সে হারিয়ে যায়।
কেউ জানত না কেন, কোথায়, কীভাবে। ফোন বন্ধ, বাড়িতেও যায়নি। ক্যাম্পাস জুড়ে গুঞ্জন। কেউ বলল প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে গেছে, কেউ বলল পরীক্ষায় ফেল করেছে।

কিন্তু নীলা জানত, এই রুদ্র ছিল অন্যরকম। সে কেবল হারিয়ে যাওয়ার মতো কেউ না।

তিন বছর কেটে গেল। নীলা এখন একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে। প্রেম করতে পারেনি আর, চিঠিগুলোকেই বুকে লুকিয়ে রেখেছে।

হঠাৎ একদিন, এক অপরিচিত ঠিকানা থেকে একটি খাম এলো তার নামে।
খুলতেই, ভেতরে সেই একই লেখা, সেই একই কালি—

"নীলা, আমি জানতাম তুমি অপেক্ষা করবে। আমি গিয়েছিলাম নিজেকে খুঁজতে। কিছু শোধ করতে। কিছু ভাঙা দায়িত্ব মেরামত করতে। কিন্তু এখন যদি তুমি চাও, আমি আবার আসতে পারি।
তুমি এখনো কি জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখো?"

নীলার চোখ ভিজে গেল।

পরের সপ্তাহে, শহরের একটি পুরনো কাফেতে দেখা হলো তাদের। রুদ্র এখনো সেই রুদ্র, তবে চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

নীলা বলল,
"তুমি কি জানো, আমি এখনো তোমার শেষ চিঠির উত্তর দিইনি?"

রুদ্র হাসল,
"তুমি যদি বলো, আমরা আবার শুরু করতে পারি।"

নীলা তাকিয়ে রইল রুদ্রের চোখে, তারপর ধীরে মাথা নাড়ল।
"তবে এবার, আমিও তোমায় চিঠি লিখব।"