ছেলেটি যে চুপ করে হাঁটতো
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। শহরের বাতিগুলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে, যেমন নিভে গিয়েছিল ইশানের নিজের গ্রাম থেকে ওঠে আসা সেই মৃদু আত্মবিশ্বাস, যে একদিন ভেবেছিল—শহর বদলাবে তাকে, অথবা সে বদলে দেবে শহরকে। কিন্তু না, সে শুধু চুপ করে হাঁটে।
শহরের সবচেয়ে পুরনো একটা মেসে থাকে ইশান। ছয়তলা পুরনো ভবনের এক কোণার ঘর। ছাদের ফাঁকে ফাঁকে চুন খসে পড়ে, জানালার কাঁচে ধুলোর স্তর এমন যেন বেদনার পালিশ।
তবু সে সেই ঘরটাকেই ভালোবাসে, কারণ এটিই একমাত্র স্থান যেখানে সে চুপচাপ নিজের ভেতর হারিয়ে যেতে পারে। মায়ের পাঠানো চিঠিগুলো একটা ছোট ট্রাঙ্কে জমা করে রাখে সে। প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর আগে একটা চিঠি পড়ে।
সেই রাতে সে পড়ছিল মায়ের চিঠি—যেখানে মা লিখেছিল:
ইশান, তুই বলেছিলি শহরের আকাশ অনেক বড়… কিন্তু জানিস রে, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, শহরের আকাশ কি তোর মতো গরিব ছেলের চোখের জল দেখতে পায়?”
ইশানের চোখ দুটো ছলছল করছিল। মা যে এমন করে লেখে, তা তো শহরের ভাষার কেউ বোঝে না।
ইশান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বাংলা সাহিত্য নিয়ে। লোকজন বলে, "এই সাবজেক্ট পড়ে কী হবে? মাস্টারি ছাড়া আর কিছু পাবি না।"
কিন্তু ইশান চায় না চাকরি বা প্রতিষ্ঠা, সে চায় ভাষার ভিতর দিয়ে জীবনের মর্ম বুঝতে। তার মতে, "যারা কবিতার মর্ম বোঝে না, তারা কখনো ভালোবাসাও বোঝে না।"
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইশান খুব কম কথা বলে। বন্ধুরা একে ‘দার্শনিক পাগল’ বলে হাসে, কিন্তু সে হাসে না। শুধু তাকায়, অনেক দূরের দিকে—যেখানে একদিন তার স্বপ্নগুলো বৃষ্টি ছুঁয়েছিল।
সেই বিকেলটাও ছিল অন্যরকম।
ইশান তখন লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে ছিল। হাতে ছিল জীবনানন্দের কবিতা। পাতা ওল্টানোর মাঝেই হঠাৎ তার পাশে এসে দাঁড়ায় একটি মেয়ে।
"এই বইটা কি আপনি পড়ছেন?"
গলা শুনেই বোঝা যায়, মেয়েটি শহরের, কিন্তু কণ্ঠে কেমন যেন চাপা বিষণ্নতা।
ইশান তাকিয়ে দেখে—মেয়েটির চোখে আগুনের মতো কিছু, কিন্তু ঠোঁটে জমে থাকা প্রশ্ন।
"হ্যাঁ, জীবনানন্দ। আপনি পড়েন না?"
"পড়তাম। এখন আর পড়ি না… জীবনের বাস্তবতা এত কঠিন যে কবিতা আর অবকাশ দেয় না," বলল মেয়েটি।
ইশান হেসে ফেলে। "জীবন তো বাস্তবতার ভেতর থেকেই কবিতা খোঁজে।"
এইভাবে তাদের কথোপকথন শুরু হয়। মেয়েটির নাম রূপা।
রূপার চোখে দুঃখের অভিজ্ঞান ছিল। সে ছিল এক ধরণের বদ্ধ জল—যা বাইরের ঝলমলে আলোয় রূপ নেয়, কিন্তু ভিতরে ভয়ানক নির্জনতা।
দিন ক’য়েক পর ইশান ও রূপার মাঝে একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ছাদের নির্জনে তারা দেখা করে—চা খায়, বই নিয়ে আলোচনা করে, মাঝে মাঝে একে অপরের চুপ করাটাকেই শব্দ বলে ধরে নেয়।
ইশান রূপাকে দেখে ভাবে, "এই মেয়েটা কাঁদে না কেন? এত দুঃখ বুকে নিয়ে কেউ কীভাবে নিঃশব্দে বাঁচে?"
রূপা বলে, "তুমি জানো, আমি যাদের মাঝে বড় হয়েছি, তারা ভালোবাসাকে দুর্বলতা ভাবে। আমার বাবা বলে, প্রেম মানুষকে ছোট করে ফেলে।"
ইশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, "আর আমার মা বলে, প্রেমে মানুষ বড় হয়। মানুষ হয়।"
ইশান একদিন সাহস করে রূপাকে একটি চিঠি দেয়—তাকে নিজের ছোট জীবনের গল্প বলে, মায়ের কথা বলে, তার ভিতরের অভাব আর ভাষার প্রেমের কথা বলে।
রূপা চিঠিটি পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর বলল,
"তোমার চিঠি, আমার জীবনের প্রথম প্রেমিক চিঠি। কিন্তু আমি জানি না আমি এটাকে কী নাম দেব।"
ইশান বলল, "নাম না দিলেও হবে, তুমি যদি আমাকে বুঝো—তবে এটিই আমার পরিপূর্ণতা।"
তাদের ভালোবাসা বাড়তে থাকে—কিন্তু শহর ভালোবাসাকে এতটা সহজে নেয় না।
রূপার বাবা মি. করিম একজন ধনকুবের, শিল্পপতি। তিনি একদিন রূপার ফোন চেক করে ইশানের চিঠিগুলো পেয়ে যান।
তারপর শুরু হয় রূপার বন্দিত্ব—তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, বাইরে যাওয়া বন্ধ, ক্লাসে যেতে দেওয়া হয় না।
ইশান ছুটে যায় তার বাসার সামনে—এক ঝলক চোখ মেলাতে চায়, কিন্তু গেটম্যান গলা চেপে ধরে, "চলে যান! মেয়ের বাবা বলছে আপনাকে যেন আর কখনো না দেখি!"
সেই রাতে ইশান ছাদে বসে কাঁদে। চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখে—যেগুলো কোনোদিন উত্তর পায়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে:
“ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তবে আমি পাপী হতে রাজি। কিন্তু আমি চাই না ওর জীবন নষ্ট হোক আমার মতো একটা নিম্নবিত্ত ছেলের কারণে।”
ইশান আর রূপা—দুই জীবন, দুই দিক থেকে হাঁটতে থাকা—কিন্তু মাঝখানে দাঁড়িয়ে সমাজ, পরিবার আর অর্থের অদৃশ্য প্রাচীর।
তবু ইশান বিশ্বাস করে, "একদিন, কোনো এক চিঠির পাতায়, রূপা আমার নাম আবার লিখবে। হয়তো চোখের জলে।"
এম সোহেল