দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত মাস্টারপ্ল্যান। ২০৪১ সালের মধ্যে এ বন্দরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইকোনমিক হাবে রূপান্তর করার লক্ষ্যেই এ পরিকল্পনা। শুধু একটি বন্দর নয়—এ অঞ্চলের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, পরিবেশ এবং জীবিকা উন্নয়নের বহুমাত্রিক লক্ষ্য নিয়েই মাস্টারপ্ল্যানটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ পরিকল্পনার আওতায় ধাপে ধাপে নির্মিত হবে মাল্টি-পারপাস টার্মিনাল, কনটেইনার টার্মিনাল, ড্রাই ও লিকুইড বাল্কসহ বিভিন্ন মেরিন টার্মিনাল। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ জলপথ সংযোগ উন্নয়নের ওপর। বন্দরকে সড়ক, রেল ও নৌপথের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি পরিকল্পনায় রয়েছে শিল্পাঞ্চল, শিপইয়ার্ড ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবও।
বন্দর ব্যবহারকারী অংশীজন ও ব্যবসায়ীদের মতে, শুধু মাস্টারপ্ল্যান করেই নয়, এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে নাব্যতা সংকট ও যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সমাধান করতে পারলে এই মাস্টারপ্ল্যান সফল হবে। সঠিক সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এই বন্দর হতে পারে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। এতে বাড়বে বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি। তৈরি হবে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান। এছাড়াও গতি আসবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাস্টারপ্ল্যানটি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিআরটিসি এবং নেদারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল হাসকোনিং ডিএইচভি। সরকারের অনুমোদনক্রমে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাস্টারপ্ল্যানের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজটি ৮টি ধাপে দুই প্রতিষ্ঠানের শতাধিক বিশেষজ্ঞ সম্পন্ন করেন। সম্প্রতি এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়।
পরিকল্পনাকারীদের দাবি, একটি সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি কেবল একটি অবকাঠামোগত পরিকল্পনা নয়, বরং একটি সমন্বিত, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন রূপরেখা, যা প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ, পরিবেশগত প্রভাব, ভবিষ্যৎ চাহিদা ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার নির্দেশনা প্রদান করে। পাশাপাশি ট্রাফিক ফোরকাস্টিং স্টাডির মাধ্যমে পণ্য চলাচলের পূর্বাভাস, চ্যানেলের অবস্থা, সিলটেশন হার, ড্রেজিংয়ের পরিমাণ ও ধরন ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি, সড়ক, রেল এবং টেলিকমিউনিকেশনসহ প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি সংযোগের রূপরেখাও মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ইতোমধ্যে পায়রা বন্দরের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ ৬৫০ মিটার জেটি, তিন লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটারের ব্যাকআপ ইয়ার্ড এবং ১০ হাজার বর্গমিটার আধুনিক সিএফএস নির্মাণ করা হয়েছে। আন্ধারমানিক নদীর ওপর সেতু এবং সংযোগ সড়কের কাজ চলছে পুরোদমে। এর মাধ্যমে আগামী বছরের জুলাইয়ে বন্দরের প্রথম টার্মিনাল কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্য রয়েছে।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ড্রেজিংয়ের জন্য পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার আছে। এটা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে কাজ হচ্ছে। আমরা আশা করি, দুই-এক মাসের মধ্যে পায়রা বন্দরের কমপক্ষে দুটি ড্রেজার অনুমোদন করাতে পারব। বরিশাল পর্যন্ত রেল লাইনের জন্য রেলপথ উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ক্যাবিনেটেও আলোচনা হবে। এছাড়া পটুয়াখালী পর্যন্ত আপাতত চার লেনের সড়ক হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি এবং বিদেশিদের প্রতি অনুরোধ করব এখানে ইন্ডাস্ট্রি করার। এখানে শিল্প এলাকার জন্য জমি রাখা হয়েছে। ছোট করে হলেও শুরু করলে একদিন বড় হবে। একটি বন্দর তৈরি হতে অনেক সময় লাগে। ১০ বছর কিছুই নয়। ২০-৩০ বছর হলে বলা যাবে পরিপূর্ণ কাজ শুরু করেছে।’
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল বলেন, ‘২০২৬ সালের জুলাই নাগাদ বন্দরের প্রথম টার্মিনালের কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্য আমাদের। নিজস্ব টার্মিনালে কার্যক্রম শুরুর আগেই জাহাজ হ্যান্ডলিং করে দুই হাজার ৭৯ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে সরকার। এই মাস্টারপ্ল্যান বন্দরের টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা পায়রা বন্দরকে একটি আধুনিক বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বন্দরের কার্যক্রমে যেন পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সে জন্য বন্দরের অপারেশনগুলো পরিবেশবান্ধব করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের জীবনমানে উন্নয়নে অবদান রাখা।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষা এবং নিরবিচ্ছিন্ন লজিস্টিক সংযোগ না থাকলে পরিকল্পনার সুফল পাওয়া কঠিন হবে। নাব্যতা যদি না থাকে, তাহলে এই বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। বড় জাহাজ আনতে হলে সাড়ে ৮ মিটার থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত গভীরতা প্রয়োজন।’
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন বলেন, ‘বন্দরের শুরুতে একটু ভুলত্রুটি হতেই পারে। সেটি ধরে আলোচনা করলে হবে না। তা হলে সামনে এগোনো যাবে না। আমি মনে করি, আমরা এগিয়ে যেতে পারি—কিভাবে সেই ব্যাপারে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নদীতে ড্রেজিংয়ের কাজগুলো নৌবাহিনীকে দিলে ভালো হবে। তাহলে কাজটি সুন্দর হবে।’
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানটি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারলে বন্দরটি ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন দ্বার হিসেবে উন্মোচিত হবে। এছাড়া ইকোনমিক জোন এবং ইপিজেড হওয়ার পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রি হলে শুধু আমদানি নয়, রপ্তানিও হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পটুয়াখালী উপপরিচালক এইচ এম শামীম বলেন, ‘কৃষিখাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন অবকাঠামোর কারণে যেন কোনোভাবেই মৎস্যখাত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইতোমধ্যে জেলেরা বলছেন নদ-নদীতে মাছ কমে গেছে। এই উন্নয়ন যেন কোনোভাবেই মাছের উৎপাদন বিস্তারে প্রভাব না ফেলে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।’
মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নকারী নেদারল্যান্ড ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল হাসকোনিং ডিএইচভির টিম লিডার মেনো মুইজ বলেন, ‘পরিবেশগত প্রভাব ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিতে মাস্টারপ্ল্যানে সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করে প্রতিকারমূলক সুপারিশ প্রদান করা হয়। ফলে মাস্টারপ্ল্যানটি কেবল প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, পরিবেশগত ও সামাজিক দিক থেকেও একটি সুরক্ষিত ও দায়িত্বশীল উন্নয়ন কাঠামোর পথপ্রদর্শক।’
সূত্র: যুগান্তর
কামরুল হাসান